হামিদুল হক:
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। আমি তখন উখিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। লজিন থাকতাম রাজাপালং দক্ষিণ পুকুরিয়া হাজী আজিজুর রহমানের বাড়িতে। মাটির তৈরী টিনের চালা দু’তলা বাড়ি। সকাল থেকে আকাশের অবস্থা তেমন ভালো মনে হচ্ছিনা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আকাশের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। সতর্ক সংকেত থেকে বিপদ সংকেতও বাড়তে থাকে। তুফানের খবর শুনলে উপকূলের লোকজনের টেনশনের সীমা থাকেনা। আমার বাড়ি জালিয়া পালং ইউনিয়নের উপকূলবর্তী গ্রাম মনখালী হওয়ায় আমার অবস্থাও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। তখন আজকের মতো মোবাইলের যোগাযোগ তো দূরের কথা, নিয়মিত গাড়ির যোগাযোগও ছিলনা। জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করে সমুদ্রের চর দিয়ে দিনে একবার চাঁদের গাড়ি নিয়ে কোটবাজার আসা যাওয়া করতে হতো। সকালে মনখালী টু কোটবাজার। আর বিকালে কোটবাজার টু মনখালী। সকালে মনখালী বিকালে কোটবাজার যাওয়ার সুযোগ নেই। হোয়াইক্যং টু মনখালী/শামলাপুর পথে চাঁদের গাড়ি চলাচল করলেও ঢালার মধ্যবর্তী সোনালী ব্যাংক নামক স্থানে নিয়মিত ডাকাতির কারণে এই পথ দিয়ে যাতায়াত কম হতো। ছেপটখালী টু পালংখালী ঢালা দিয়ে যোগাযোগ তখন প্রায় কমে গিয়েছিল। এখন ককসবাজার টু টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ দিয়ে দেশবিদেশের লোকজন টাকা খরচ করে উপকূলীয় এলাকা দেখতে আসেন। দূপুরের পর থেকে আকাশের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। আমার মনের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। এলাকার লোকজন জটলা হয়ে রেডিওতে সংকেত শুনে। আমিও তাদের ফাঁক দিয়ে সংকেত শুনে আসি। এভাবে দুপুর থেকে বিকেল, বিকেল থেকে সন্ধ্যা। রাতে বাতাসের গতিবেগ বাড়ার সাথে সাথে আমার লজিন বাড়ির অবস্থাও খারাপ হতে থাকে। দু’তলা মাটির ঘরের টিনের চালায় জোরে বাতাসের ঢাক্কা লাগলে মনে হয় চালাটি এখনি উড়ে যাবে। সময় যতই বাড়ছে চালা নিয়ে টেনশনও বাড়ছে।বাবা মা বাড়ির লোকজনের চিন্তায় আমারতো আরো খারাপ। এটি কারো নিকট ব্যক্তও করা যাচ্ছেনা। গভীর রাতে বাড়ির চালাটি রক্ষার উপায় খুঁজতে লাগলাম আমি ও হাজী সাহেবের কলেজ পড়ুয়া ছেলে নুরু দুদু(নুরুল আলম)। শক্ত কিছু দিয়ে চালাটি নিচের কোন গাছ অথবা জানালা দিয়ে আটকিয়ে দিতে পারলে হয়তো রক্ষা হতে পারে। কিছু পাওয়া যায় কিনা এই আশায় অন্ধকারে আমরা দু’জন বের হলাম। চালা আটকানোর মতো কিছু পাচ্ছিলামনা। শেষমেষ আমার মাথায় একটি বুদ্ধি আসল। অনতি দূরে নুরু দুদুর চাচা ডাক্তার এরশাদ সাহেব নতুন ঘর করার জন্য লোহার রড এনে রেখেছেন। রড দিয়ে চালাটি নিচের কিছুর সাথে বেঁধে দিতে পারলে রক্ষা হবে। ডাক্তার সাহেবের অজান্তে খারাপ পরিস্থিতিতে দু’জনে মিলে রড এনে সবাই মিলে চালাটি জানালার সাথে আটকিয়ে দেয়াতে আল্লাহর মোহেরবানিতে রক্ষা হয়। সকালে উঠে দেখি বাইরে সবকিছু লন্ডভন্ড। বাড়ির কথা মনে পড়ায় মনের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় বাড়ি যাওয়াতো সম্ভব নয়। রেডিওর শুনলাম মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ, হাতিয়াসহ উপকূপে তেমন কিছুই বাকী নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ ও গবাদী পশু মারা গেছে।দুপুরে অনেক কষ্টকোে টবাজার হয়ে মনখালী গিয়ে দেখি সবকিছু লন্ডভন্ড। গাছপালা তেমন নেই। তবে আল্লাহর মেহেরবাণীতে কেউ হারিয়ে যাননি। উপকূলীয় অন্যান্য স্থানে কি ঘটেছে এটি সবারই জানা। কয়েক লক্ষ লোক ও লক্ষ লক্ষ পশুপাখির সলিল সামধি। বাড়িঘর ও অন্যান্য সম্পদের কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এমন অসংখ্য পরিবার ছিল যাদের পরিবারে কেউ জীবিত ছিলেননা। আমার জানামতে মহেশখালীর এমনই একজন ছিলেন পরিবারে তিনি ব্যতীত আর কেউ বেঁচে নেই। পড়ালেখার জন্য চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান করায় আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এর পর থেকে তিনি আর এলাকায় যেতে চাননি। হে মহান রব এ ধরনের বিপদ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন। ১৯৯১সনের ২৯ এপ্রিল যারা মারা গেছেন তাঁদেরকে আপনি ক্ষমা করে জান্নাত নসিব করুন। বর্তমান করোনা ভাইরাস নামক মহামারি থেকেও আমাদের রক্ষা করুন। যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। জান্নাতবাসী করুন। আমিন।